Ad imageAd image

আতর জ্বীন

সোহান আহমেদ তন্ময়

কিশোরগঞ্জ পোস্ট
কিশোরগঞ্জ পোস্ট
আতর জ্বিন

ছাতিমপুরে সন্ধ্যা নামত সন্ধ্যার একটু আগেই। গাঁয়ের আকাশটা যে ঘিরে রাখত দৈত্যের মত বড় বড় ছাতিমগাছ গুলো! তবে এরা গাছ না সুগন্ধী জ্ব তা কেও ঠিক ঠিক  জানেনা। গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যেন অন্ধকার এসে পড়ত সময়ের আগে আগে।তেমনি গাঁয়ের লোকেরাও।ছাতিমের গন্ধে উঁচু ডালে বসে ভুতগুলো যখন চাঁদের আলো মাখত গায়ে এর আগেই  লোকেরা ঘরে ফিরত।অবশ্য তেনাদের আর শরীর কী,কেউ কি দেখেছে কখনো? যদি কেও দেখেও থাকে তারাও হয়ত উঁচু ডালে উঠে এখন আলো মাখছে। কেউ কেউ হয়ত সুগন্ধি জিনেদের দেখেও ঘরে ফিরেছে। কিন্তু তাদের শরীর থেকে সুবাস যায়নি। এদের মত কেউ কেউ বাজার করতে গেলে  মাছমলেও ঘুরপাক খেত ছাতিমের সুগন্ধি। এইগন্ধের এক অদ্ভুত গুণ। কাছে এলে মনে হয় অনেক দূর থেকে আসছে গন্ধটা,কেও তাই ঠাওর করতে পারে না।আলাউদ্দিন যখন অনেক ছোট সে নিজেই এমন ঘটনার  সাক্ষী।তবে তা অনেক দিন আগের কথা। তার ছেলে রায়হান মিয়া কে সে এই কথা নিজ মুখেই বলেছে ঘুম পাড়ানোর সময়। তাও অনেক আগে। রায়হান এখন  স্কুলে যায়,বন্ধুও হয়েছে দুই তিনজন।তারা যে পথটা দিয়ে ফেরে সেদিকটাতে আর কোন ছাতিম টাতিম নাই।এমনকি তারা  খেলে

যে মাঠটাতে সেখানেও নাই। মেলা হয় বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরেই,ঈদ-পূজাতে। নদী পার হয়ে মেলা দেখতে যেতে হয়। কিন্তু কোথাও-ই আর সুগন্ধি জ্বীনদের তার চোখে পড়ে না। তাহলে কি তার আব্বা, তার বন্ধুদের আব্বারা তাদের সাথে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে? রায়হান  সাইকেলে চড়ে স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে আলাউদ্দিন এর কাছে জানতে চায়। আলাউদ্দিন বলে, আলোমাখা ভূত সংখ্যা বাইড়া গেসিলো,লোক জনের গাঁও থেইকা বাসনা আইত। লোকে ভয় পায়া সব কাইট্টালছে। পুরানা রেলইস্টিশনে কয়ডা থাকতারে! রায়হান বায়না করেছিল নিয়ে যেতে,সাইকেল ই তো আছে,কিন্তু সে নিয়ে যায় নি সেদিন আর।

পরদিন বৃহস্পতিবার । হাফ স্কুল, ছুটির পর রায়হান বন্ধুদের সাথে দুপুর থাকতে থাকতে পুরানা রেলস্টেশনের পথধরে বাড়ি ফিরে,তার কাছে ভয়ের কিছুই লাগে নি কিন্তু চনমন করে হাওয়া। ম-ম গন্ধে কিসের জানি ফিশফাশ! রায়হান বুঝতে পারেনা এরাই কি তাহলে সুগন্ধি জ্বিন? দশ বারোটা সবুজ দানব যেন দুইপাশে দাড়িয়ে আছে রাস্তাটার। তাদের গায়ে সাদা সাদা ফুটি ফুটি ফুল । এটাকে ঠিক রাস্তাও বলা যায় না। রেললাইন। অচল,ঘাস উঠে ভরে গেছে।রায়হান আর তার বন্ধুদের ঠিক ভয় করে নাই অইদিন বিকেলে।কেমন জানি আদর লেগেছে মাথায়, চুলে, সুবাস যেন নাক দিয়ে ঢুকে সারা গায়ে হাত বুলাচ্ছে,আম্মার মত। কিন্তু ছাতিমের নিচ দিয়ে আসার সময় বিকাল টা কেমন হলুদ হয়ে আসছিল। বন্ধুরাও বলেছে। রায়হান তার আম্মারে জিজ্ঞেস করে।শারমিন বলতে পারেনি হেমন্তের জন্যই কি হলুদ হয়ে এসেছিল বিকালটা না তারা সুগন্ধী জ্বিন দেখে বাড়ি ফিরল দেখে। সেদিন বিকালে শারমিন একটা ভালই ভাতঘুম দিয়েছিল,বের হয়নি বাড়ি  থেকে। তাই সে জানে না বিকাল  হলুদ  হবার কারণ।

তার কিছুদিন পরে  সে তার  আব্বার সাথে বাজার এর জন্য বের হয় সকাল সকাল।আলাউদ্দিন স’ মিলে যায়। একটা নতুন আলমারি বানানোর আবদার করেছে শারমিন, তার জন্যেই ভাল কাঠের সন্ধানে আসা।স’মিলে ঢোকার পর থেকে রায়হান কি যেন গন্ধ পাচ্ছে। কিছুক্ষণ গেছে পরে সে গন্ধটা চিনতে পারে।গন্ধ ধরে ধরে সে খুজতে খুজতে স’মিলের পেছনের দিকে যায়।আলাউদ্দিন ও তার পিছন পিছন যায়।তারা প্রায় একসাথেই গন্ধটা পায়, যেন গন্ধের  বিল।যেন তারা সাতার কাটছে তাতে। তারা দেখে,কে যেন শেষ কয়টা  সুগন্ধি জ্বীনেদের কেটে ফেলে গেছে এখানে। আলাউদ্দিন এসে জিজ্ঞেস করে স’মিল এর একজনকে।সে খুব হড়বড়  করে বলে,পুরান রেললাইন ঠিক করাইব।সরকারী লোকজন ই কাটছে। আকাইম্মা গাছ। কামে তো আয়ে না। এক পারটির লগে মাহাজন আলাপ করছিল।হেরা কফিন বানানির লাইজ্ঞা কিনব। এডভান্স করছে। সবগুলাই কিইনা নিসে। কিন্তু ভয় অইল আলো-মাখানি ভুত গুলারে নিয়া।তিনারা কই যাইব অইডাই চিন্তার বিষয়। জানামতে আর কুনু ছাতিম ই তো থাকল না ছাতিমপুরে।আলাউদ্দিন একটু ভয় পেল যেন!

- Advertisement -

রায়হান কেন জানি খুব চুপ হয়ে গেল। বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে স্কুলে যায়। ফিরে আসে। বিকালে ঘুমায়।স ন্ধ্যায় উঠে বুঝে না রাত না সকাল। অই রাতে সে পড়তেও বসে নাই। তার ছাতিম গাছ গুলার জন্য মায়া হচ্ছিল। পর দিন স্কুলে যায়। টিফিন এর ঘন্টা পড়েছে। তাদের স্কুল টা বেশ পুরানো। তার আব্বার থেকে শোনা যুদ্ধের ও আগের। তা প্রায় ৫০ ৬০ বছর হবেই। কিন্তু মাঠের শেষে  শিরিশ গাছের নিচে যে  পায়খানা টা ওটা দেখতে আরো পুরানো। রায়হান  প্রস্রাব করে বের হয়।রায়হানের নাকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসে। সুগন্ধি জ্বীনের গন্ধ এটা,ও বুঝতে পারে। সে খোঁজে। শিরিশ গাছের সাথেই আরেকটা গাছ দেখে সে। তার মনে হল এখানে তো আর কোন গাছ ছিল না। সে ভয় পায়। প্রায় দুই তালার মত লম্বা। এত বড় গাছ কবে হলো। সে বুঝে উঠার আগেই দেখতে দেখতে আরো কয়েক হাত বাড়ল গাছ টা, ভয় পেয়ে দৌড় দেয় সে। সবাই  ই মাঠে জড় হয়েছে। ঘন্টা দিচ্ছে রওশন খালা।তাল ঠিক রাখতে পারছে না। ভয়ে উলটা পালটা হয়ে যাচ্ছে। হেডস্যার সবাইকে জড় হতে বলছেন মাইকে। সবাই জড় হলে তিন বললেন, তোমরা সবাই এখন ই বাড়ি চলে যাও। সারা গ্রাম থেকে খবর আসছে জায়গায় জায়গায় ছাতিম গাছ দেখা যাচ্ছে,তিনারা তো আসলে সুগন্ধি জ্বিন। চোখের নিমিষেই  বড় হচ্ছেন,থোকায় থোকায় ফুল দিচ্ছেন।আর এই সুগন্ধি  জ্বিনের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে লোকজন। তোমরা নাকে  ধরে একসাথে আলো থাকতে থাকতেই বাড়ির দিকে রওনা হও।তিনারা চাঁদের আলো গায়ে মাখে।এই আলো অন্য কারো গায়ে লাগুক এইটা তাদের পছন্দ না!

সেদিন তারা দিনেরআলোতেই বাড়ি ফিরতে পেরেছিল । পথে তারা  সত্য সত্যই আতর জ্বীনেদের দেখেছিল। সবুজ ট্রেনের মত আকাশের দিকে রওনা দিয়েছেন। এত বাতাস তারা কোনদিন চোখে দেখে নাই,জ্বীনরা যেন নাচতেছিল বাতাসে।  বায়োস্কোপে চোখ রাখলে যেমন,  সবকিছু তেমন লাগছিল রায়হানের কাছে- গত শুক্রবারই রহমান মন্ডল আসছিল স্কুলে,টিফিনের সময় বন্ধুরা মিলে বায়োস্কোপ দেখেছে তারা। থোকায় থোকায় ছাতিমের সাদা ফুলগুলো তেমন করেই ফুটতে থাকে গাছে।গন্ধে গোটা গ্রামটাই থ মেরে আছে,ছাতিমের ট্রেন গুলা শুধু চলছে,আকাশের দিকে।সবাই নাক ধরেই বাড়ি ফিরেছে, গন্ধটা সহ্য করা যায়না,ঘুম আসে। এক দুই জন যে গাছের নিচে মাঠে স্কুলের গেইটের পাশে পুকুরের ঘাটে ঘুমিয়ে পড়েনি এমন নয়,কিন্তু তারা অজ্ঞান হয় নি। বাড়ি থেকে লোক গিয়ে কোলে করে নিয়ে এসেছে। তারা আস্তে আস্তে সজাগ হয়েছে। রায়হান তার বাসায় এসে দেখে উঠানেই দুইটা  আতর জ্বিন বুপ্রের দিকে উঠছে,তার গায়ে ফুটি ফুটি ফুল  হুল ফুটাচ্ছে যেন। রাতে সারা বাড়িতেই হয়ত সারা গাঁয়েই এমন শো শো বাতাস হল। পুরা গ্রামটা এক থোকা ছাতিম ফুলের মত দুলছে যেন, আর কি সুবাস,সে রাতে তাদের সবার কত আরামের ঘুম হল। ঘুমের ভিতর আতর জ্বিনেরা দুলছিল। রায়হানএর আর কিছুই  মনে নাই।

অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে রায়হান। এর পর আর ক্ষণে ক্ষণে ঘুম পায় নি। তাদের নাক সয়ে গেছে গন্ধ টা। আলাদা করা না গেলেও তাদের সবার শরীর থেকেই  সুবাস আসছিল,পায়খানাতে বসেও রায়হান গন্ধ পায় আতর জ্বীনের, তা কি পেছনে থাকা ছাতিম গাছ থেকে না তার নিজের শরীর থেকেই আসছে বুঝতে পারে না রায়হান। ছাতিমের  ডালগুলা যখন বাতাসে ঝাপটা মারে  তারা মাথায় বিলি কেটে কেটে কি জানি ফিশফিশ করে। রায়হান মন দিয়ে শুনে। কিছু কিছু সে বুঝতেও পারে। কিন্তু বলতে পারে না  বন্ধুদের। তার আব্বা  বা আম্মা রে সে বলতে চায় না।একটু ভয় ই করে বলতে,সে ও কি আতর জ্বীন হয়ে যাচ্ছে তাহলে! কিন্তু  রায়হান ভাবে মামুন-ও-তো হেইদিন কইলো, আতর জ্বীনডি  অনেক ভালা । কিরুম আদর কইরা কতা কয়,মনোয় ঘুমায়া যাইতাসি,কিন্তু অয় কিচছু মনো থাহে না,খালি মনোয় কেউ আমার সারা শইল হাতায়া দিতাসিন,নানুর লাগান। আর যেইবা গন্ধ হয়,ভাইরে ভাই।  রায়হান ভাবে,আমরা সবাই-ই তাইলে আতর জ্বীন হইয়া যাইতাছি!

চলবে…………………

Subscribe

Subscribe to our newsletter to get our newest articles instantly!

ফলো করুন

সোশ্যাল মিডিয়াতে আমাদের সাথে থাকুন
জনপ্রিয় খবর
মতামত দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *