বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে এ নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডের কারণেই এই নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়ায় উল্লেখ করা হয়, গত ১৫ বছরে ছাত্রলীগ হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ধর্ষণ, এবং যৌন নিপীড়নের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। সাম্প্রতিককালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাদের নৃশংস হামলায় বহু নিরীহ শিক্ষার্থী ও সাধারণ নাগরিক আহত ও নিহত হয়েছেন। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কারণে সংগঠনটিকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯’ অনুযায়ী নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের প্রেক্ষাপট
গত ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ আহত হয়। আন্দোলনকারী ছাত্ররা ছাত্রলীগের এই আচরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে। তারা সরকারকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার রাতে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
সরকারের প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত রয়েছে। তাই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ছাত্রলীগের ইতিহাস ও সমালোচনা
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সংগঠনটি অভ্যন্তরীণ কোন্দল, ক্ষমতার লড়াই এবং নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতন এবং খুনের কারণে ছাত্রলীগ ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। ২০১৯ সালে বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনার পর সংগঠনটির নেতিবাচক ভাবমূর্তি আরও প্রকট হয়।
আন্দোলনকারীদের প্রতিক্রিয়া ও আনন্দ মিছিল
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ার খবরে আন্দোলনকারী ছাত্ররা উল্লাসে ফেটে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে একটি বিশাল আনন্দ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি উপাচার্যের বাসভবন থেকে শুরু হয়ে রাজু ভাস্কর্যে এসে শেষ হয়। এ সময় বক্তারা ছাত্রলীগের নিষিদ্ধকে দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি বড় বিজয় হিসেবে আখ্যা দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, “বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের পুনর্বাসন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ছাত্রলীগ দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসগুলোকে নির্যাতনকেন্দ্রে পরিণত করেছে। তাদের নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি ছিল।”
সরকারের পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ছাত্রলীগের যারা অপরাধে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
সরকারি কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের সম্পদের বিষয়ে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। গণমাধ্যমে ছাত্রলীগের কোনো প্রচারণা বা কার্যক্রম প্রকাশ করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কেউ এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ছাত্রলীগের নিষেধাজ্ঞার পর সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। তবে রাতেই ছাত্রলীগের প্যাডে এক বিবৃতি গণমাধ্যমে পাঠানো হয়, যেখানে তারা সরকারের সিদ্ধান্তকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক বলে উল্লেখ করে।
ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট
ছাত্রলীগের নিষিদ্ধের ফলে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এছাড়া সরকারের এই পদক্ষেপ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও নতুন দিক উন্মোচন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
Subscribe
Subscribe to our newsletter to get our newest articles instantly!