প্রথম পর্ব
১৬ই ডিসেম্বর,৩০১৯ সাল।।।
বাংলার ভঙ্গুর জলবায়ু বৈশ্বিক উষ্ণতার সাথে সখ্যতা গড়ে নিয়েছে গত শতাব্দীতেই। অনিশ্চিত ভৌগলিক অবস্থানে বিশ্ব বরেণ্য জলবায়ু বিশ্লেষকদের বরাবরের মতই এ শতাব্দীতেও চমকিত করে চলেছে ডি এল রায়ের সকল দেশের রাণী আমার জন্মভূমি।। ২৫৯৯ সালের শেষদিকে বিশ্ব পরিবেশ সংস্থা “বাঙালীদের কর্মফল” শিরোনামে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তাতে বৈশ্বিক উষ্ণতার দরুণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য বাংলার ৯৫ ভাগ স্থলভাগ হারিয়ে যাবে অতল জলগর্ভে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।। প্রতিবেদনে বিশেষত বৈজ্ঞানিক অনুকল্পসমৃদ্ধ বিবৃতি দান করেছিলেন সমসাময়িক বিজ্ঞানীসমাজ।। পশ্চিমা স্বঘোষিত উচ্চশ্রেণির সাহেবগনের মাঝে এই প্রতিবেদন এক পৈশাচিক প্রশান্তির দোলা দিলেও তারা বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাংলার বিশ্বায়নে পিছিয়ে পড়া আপামর জনতার সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে কম কাঠ-খড় পোড়ায়নি।
ফলপ্রসূ কোন পরিবর্তনে ব্যার্থতা এক রকম চরমে পৌছালে এই প্রতিবেদন লাট সমাজে একটু স্বস্তিই এনেছিল।। তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা,অস্বাভাবিক জনসংখ্যা ঘনত্ব, শেকেলে শিক্ষা ব্যবস্থা,মহাবিশ্বের নিয়তিসংক্রান্ত অজ্ঞতা,জাতীয় সম্পদের ঘাটতি ও অসম বণ্টন,প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানুষের মাঝে মানবিক অবক্ষয়,পার্শ্ববর্তী দেশের জল-সন্রাসের স্বীকার হয়ে সোনার বাংলা রুপ নিয়েছিল এক বিভীষিকাময় পার্থিব নরকে।।জান্নাতাবাদের এ চিত্র পূর্বানুমেয় হলেও বাঙালির সীমিত চিন্তা-গগনে তখনও অর্করুপে উদিত হয়নি তা।। প্রায় ৬০ কোটি মানুষের এই ক্ষুদ্র মানচিত্র নিশ্চিত নিশ্চিহ্ন হওয়ার এক নিষ্ঠুর অপেক্ষায় ক্লান্ত-ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেছিল। দুর্ভিক্ষপীড়িত মায়ের শুষ্কস্তনে যেরুপে সদ্যোজাত মানবশিশু সর্বশেষ দুগ্ধাণুপানে মাতৃস্তনকে আমরণ-চুষ্য গ্রন্থিতে পরিণত করে বাংলা মায়ের পরম স্নেহের সন্তানদেরও ছিল তদ্রুপ খাদ্য-সংকুলানে ব্যগ্রতা।জনসংখ্যাবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রনে একবিংশ শতাব্দী অবধি পর্যায়ক্রমিক ব্যর্থতা জনবিষ্ফোরণের রুপ নেয় ত্রয়োবিংশ শতাব্দীতে। যদিও একবিংশ শতাব্দীতে বাংলার ক্রমবর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর জনসম্পদে রুপান্তরের সম্ভাবনা বর্ণনায় ঘাটতি রাখেনি পশ্চিমা হিতৈষীগণ।একদিকে বাংলাকে দিয়েছিলেন উন্নয়নশীল দেশের তকমা অন্যদিকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে কম্পিউটারকে দিয়েছিলেন মানববুদ্ধিমত্তার সীমা লঙ্ঘনে সক্ষম কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। যার ফলশ্রুতিতে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব নামের অভিশাাপ নেমে আসে প্রযুক্তিতে অনগ্রসর বাংলার জনজীবনে। বাংলার অর্থাকাশ ছেয়ে যায় নিশ্চিত কর্মহীনতার গভীর কালোমেঘে।দেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয় কোটি কোটি কায়িকশ্রমনির্ভর শ্রমজীবীদের যাদের রক্তিম ঘর্মবিন্দুতে প্লাবিত হত প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্য। যাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বেচাকেনা হত সভ্যদুনিয়ায় পটল-আলুর দরে, তাদের কাধেই ভর করে স্বল্পতুষ্ট বাঙালী পাড়ি দিতো জীবননামের অথৈই পাথার।আর কৃত্তিমবুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা এক নিমেষেই নিমজ্জিত করে বাংলার স্বপ্নতরী অনিশ্চয়তার মধ্যসমুদ্রে। ধরিত্রীমাতার নিরব পর্যবেক্ষণ চলতে থাকে।
একই মায়ের কিছু প্রগতিশীল সন্তান তথ্যপ্রযুক্তি নামের বোরাকে চড়ে অনায়াসে পাড়ি জমায় সু-সংজ্ঞায়িত জীবনের কল্পরাজ্যে আর সেই বোরাকের খুরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় সারল্যের তারল্যে নিমজ্জিত তথাকথিত প্রযুক্তির যুগে পশ্চাদপদ নিরীহ সন্তানেরা।বাংলার অর্থনীতির এহেন পরিস্থিতিতে কফিনের শেষ পেরেক ঠুকতে বিলম্ব করেনি অটোমেটেড গার্মেন্টস প্রোডাকশন সিস্টেম যার ফলে বাংলার সেলাই-দিদিমণিরা আসনচ্যূত হয় বিশ্ব-পোশাকশিল্পের সিঁথিতে রাঙা-সিদুঁর পড়ানো গৌরবগাঁথা মহান আসন হতে,তার সাথে সাথে সূচকীয় হারে বাড়তে থাকে বাংলা মায়ের বৈদেশিক ঋণের গিরিসম বোঝা।। বিজ্ঞান জগতের আলাদিনের চেরাগখ্যাত জিন এডিটিং টুল ক্রিসপার কর্তৃক কৃত্তিম উপায়ে ইলিশ, চিংড়িসহ প্রাকৃতিক উৎস হতে লভ্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনশীল মৎসজাত দ্রব্যের নিয়ন্ত্রিত উৎপাদন কেড়ে নেয় বাংলা মায়ের আচঁলেগাথাঁ শেষ আধুলিগুলো। কোন এককালে যে বাংলা মায়ের রুপ-লাবণ্যে,ঐশ্বর্য-গরিমায়,মমতার প্রাচুর্যে ঝলসে যেত বিশ্বনয়ন, অশিক্ষা-কুশিক্ষা আর বিজ্ঞানবিমুখ ক্ষমতা প্রত্যায়নি বলসর্বস্ব রাজনৈতিক সংষ্কৃতির কষাঘাতে সে মায়ের মলিন বদন প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা অতিক্রমে হয়ে পড়েছিল মুমূর্ষু। বাংলা মায়ের সেই বিভৎস চিত্র হয়তো জয়নুল আবেদীনও তার পটে দৃশ্যায়িত করতে পারতেন না।এমনকি বিশ্বনন্দিত কোন শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব ছিলনা।
তদুপরি কিছু অপার্থিব চেতনাসম্পন্ন সমসাময়িক শিল্পীর ভাবানুবাদের যে প্রমাণ পাওয়া যায় তাতে পারলৌকিক জাহান্নামের ব্যাপ্ত প্রতিফলন ঘটে যার কোন বাস্তব অথবা অবাস্তব বিম্ব এখন কল্পনা করা না গেলেও লোমহর্ষক অনূভূতিতে অস্তিত্বশীল। মানবতার এহেন বিপর্যয়ে বিশ্বমানবতা ছিল নিরব দর্শক কেননা বিশ্ব রাজনীতিতে আবির্ভূত হয় এমন এক দর্শনের যেখানে আন্তঃনাক্ষত্রিক প্রাণী হিসেবে টিকে থাকার কাছে অতিকায় অফলা জনগোষ্ঠীর ক্ষুধার্ত ক্রন্দনরোল ডপলার এফেক্টের নিয়মে ক্ষীণ ও অস্পষ্ট হয়ে যায়।হয়ত সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দূর থেকে দূরতর হতে থাকে জাতিসমূহের সহাবস্থান আর তথাকথিত বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব পর্যবসিত হয় এক নিষ্ফল আশ্বাসে।কেবল বাংলা নয় তৎকালীন সময়ে ধরার আধুনিক প্রযুক্তিতে অনগ্রসর জাতির ভাগ্যাকাশে নির্মম পরিণতি আষাঢ়ের আাকাশে উদ্ভ্রান্ত মেঘের ন্যায় ছুটোছুটি করছিল এক হিংস্র গতিতে।ফলশ্রুতিতে কত নাম না জানা মানবগোষ্ঠি হারিয়ে গিয়েছিল মহাকালের অতল গহ্বরে ।বৈশ্বিক এককেন্দ্রিক সম্পদ বণ্টন ও সংগ্রহ নীতির নামে পৃথিবীর সকল প্রাকৃতিক সম্পদ এমন এক শোসকশ্রেণীর হস্তগত হয় যারা সমস্ত সম্পদ আন্তঃনাক্ষত্রিক বাসস্থান অনুসন্ধান প্রকল্পে খরচ করতে থাকে।।তখন দেশে-দেশে বা জাতিতে জাতিতে কোন সংঘাত বা আধিপত্য বিস্তারের কূটকৌশল নিয়ে জল্পনার কারণ ছিলনা,কেননা সমস্ত বিশ্বের সকল এলিট শ্রেণির মানুষ বিশ্ব সম্পদ কুক্ষিগত করে দূষণমুক্ত এক মহাদেশীয় ভূখণ্ড নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করে। নিউজিল্যান্ড এর নিকটবর্তী জিলান্ডিয়া নামের এ ভূখন্ডের আবির্ভাব হয় সমুদ্রতলদেশ হতে যার দরুণ এর মাটি উর্বর ও খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ ছিল। ধরিত্রীমাতার এই উর্বর প্রসব কেবল তাদেরকেই তৃপ্ত করেছিল যারা গোটা মানবজাতিকে অতৃপ্তির দাবানলে দগ্ধ করেছিল সহস্রাব্দ। থাক, সমসাময়িক বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে বর্ণনা করার চাইতে আবার আমার বাংলা মায়ের সেই শুষ্ক,ক্ষুধার্ত,মলিন বদনের দিকে আলোকপাত করা যাক।
(চলবে)
Subscribe
Subscribe to our newsletter to get our newest articles instantly!